অ্যাকটিনোমাইসিটিস | একটি অণুজীবের নাম



আজকে আমরা জানব অ্যাকটিনোমাইসিটিস সম্পর্কে। প্রথমেই প্রশ্ন হলো অ্যাকটিনোমাইসিটিস কি?
অ্যাকটিনোমাইসিটিস হলো এক ধরণের অণুজীব। আদিকোষী এই অণুজীব হতে পারে এককোষী বা বহুকোষী। এরা সালোকসংশ্লেষণে অক্ষম এবং বংশবৃদ্ধি করে স্পোর সৃষ্টির মাধ্যমে। এদের দেহ সাধারণত সূত্রাকার শাখান্বিত এবং প্রস্থপ্রাচীরবিহীন।

কে সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেছিলেন অ্যাকটিনোমাইসিটিস?
‘ফানির্ডনান্ড কন’ নামক একজন বিজ্ঞানী। ১৮৭৫ সালে তিনি এক প্রকার সূত্রাকার অণুজীব আবিষ্কার করেন মানুষের অশ্রুনালী হতে। তিনি এদের নাম দিয়েছিলেন Streptothrix foerstem। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো তার ঐ নামটি অণুজীবের নাম হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়নি।

১৮৭৭ সালে হার্ব নামক একজন বিজ্ঞানী লাম্ফি জ্ব বা চোয়াল ফোলা রোগে আক্রান্ত গরুর দেহ হতে এক প্রকার সূত্রাকার অণুজীব পৃথক করে নাম দেন Actinomyces bovis। পরবর্তীতে এ ধরনের অণুজীবসমূহকে অ্যাকটিনোমাইসিটিস নাম দেন দুইজন বিজ্ঞানী গ্যাসপারিনি ও ল্যাসনার স্যান্ডভাল।

কেন এদের অ্যাকটিনোমাইসিটিস নাম দেয়া হলো?
কারণ হলো, এদের কলোনীকে Actinomorphic বা বহুতলে বিভক্ত করা যায়।

আপনি কি জানেন, স্ট্রেপটোমাইসিন এন্টিবায়োটিক তৈরি করা হয় অ্যাকটিনোমাইসিটিস দিয়ে? S. A. Waksman ছিলেন রাশিয়ান বিজ্ঞানী যিনি আমেরিকায় বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অণুজীববিজ্ঞান ইনিস্টিটিউটের পরিচালক। তিনি একদিন কবরস্থানে হাঁটার সময় পিছলে পড়ে যান। তিনি সেই স্থানের মাটি নিয়ে শুরু করেন গবেষণা। সেই মাটি থেকেই Streptomyces griseus নামক অ্যাকটিনোমাইসিটিস আবিষ্কার করেন ১৯৪০ সালে। পরবর্তীতে এই অ্যাকিটিনোমাইসিটিস থেকেই আবিষ্কার করেন স্ট্রেপটোমাইসিন এন্টিবায়োটিক। এই সাফল্যের জন্য তাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় ১৯৫২ সালে।

অ্যাকটিনোমাইসিটিস এর স্বভাব ও বসতি কেমন?
প্রকৃতিতে প্রায় সর্বত্রই বিরাজ করে অ্যাকটিনোমাইসিটিস। এদেরকে পাওয়া যায় মাটি, পচনশীল জৈব পদার্থ, জলাশয়, খাদ্যদ্রব্য এবং বায়ুতে। এদের বৃদ্ধি হয় অত্যন্ত ধীর গতিতে। কৃত্রিম আবাদ মাধ্যমে শক্ত ও সাদাটে ধরণের কলোনী সৃষ্টি করে এরা। এরা প্রচুর পরিমাণে জন্মে ঐ সমস্ত অরণ্যভূমিতে যা পর্যাপ্ত জৈব পদার্থে ভরপুর। মৃতজীবী বা পরজীবী হিসেবে জীবনধারণ করে এরা। কেউ কেউ আবার রোগ সৃষ্টি করে উদ্ভিদের দেহে। শুধু উদ্ভিদ নয়, গৃহপালিত পশু-পাখি এমনকি মানুষের রোগ সৃষ্টি করে অ্যাকটিনোমাইসিটিস।

অ্যাকটিনোমাইসিটিস অন্যান্য অণুজীবের চেয়ে দীর্ঘসময় এবং প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। এদের স্পোর উচ্চ তাপ প্রতিরোধের ক্ষমতা সম্পন্ন। বিজ্ঞানী Meiklesohn দেখিয়েছিলেন, কেনিয়াতে প্রচন্ড খরার সময় যে অণুজীবেরা টিকে ছিল তাদের ৯০% ই ছিল অ্যাকটিনোমাইসিটিস। অনেক মরুভূমিতে অ্যাকটিনোমাইসিটিস এর পরিমাণ অন্য যেকোন অণুজীব অপেক্ষা বেশী। সাধারণত ২৮-৩৭ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় অ্যাটিনোমাইসিটিসের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ঘটে।

অ্যাকটিনোমাইসিটিস এর গঠন কিরূপ?
এদের দেহ সূত্রাকার ও শাখান্বিত। দেহ সিনোসাইটিক অর্থাৎ অণুসূত্রগুলো প্রস্থপ্রাচীরবিহীন। অণুসূত্রগুলো মাইসেলিয়াম গঠন করে। মাইসেলিয়ামের হাইফির ব্যাস হতে পারে ০.৫ থেকে ১.২ মাইক্রন।

কোন কোন অ্যাকটিনোমাইসিসিটিস এর হাইফি উৎপন্ন হয় একটি কেন্দ্রীয় বিন্দু থেকে। তারপর বিভিন্ন ব্যাসার্ধে সমানভাবে বিস্তৃত হয় এবং সৃষ্টি করে একটি বৃত্তাকার মাইসেলিয়াম। তরুণ হাইফার প্রোটোপ্লাজম বিভেদিত থাকে না। কিন্তু বয়স্ক ও পরিণত মাইসেলিয়ামের প্রোটোপ্লাজম নির্দিষ্ট আকারের গঠন ও গহ্বরে বিভেদিত থাকে।
অ্যাকটিনোমাইসিটিস দুই ধরণের মাইসেলিয়াম উৎপন্ন করে-
১। প্রাইমারি মাইসেলিয়াম: এ ধরনের মাইসেলিয়ামের হাইফি অত্যন্ত নরম ও অনেক শাখাযুক্ত।
২। সেকেন্ডারি বা গৌণ মাইসেলিয়াম: এগুলো প্রাইমারি মাইসেলিয়াম হতে উপরের দিকে উঠে আসে। এদের ব্যাস প্রাইমারি মাইসেলিয়ামের হাইফার ব্যাসের চেয়ে কিছুটা বেশি। এ ধরনের হাইফির ব্যাবধায়ক বা পার্শ্ব প্রাচীর থাকে।

কোন কোন অণুজীবের সাথে তুলনা করা যায় অ্যাকটিনোমাইসিটিসকে?
উত্তর হলো, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক।

ব্যাকটেরিয়ার সাথে সম্বন্ধপরতা:
অ্যাকটিনোমাইসিটিস এর হাইফি এবং স্পোরের ব্যাস ব্যাকটেরিয়ার মতোই। ব্যাকটেরিয়ার মতোই এরা প্রাককেন্দ্রিক এবং এদের কোষে কাইটিন বা সেলুলোজ নেই। দুটি অণুজীবই গ্রাম বিক্রিয়া প্রদর্শন করে। ঐসব অ্যাকটিনোমাইসিটিস যারা বায়বীয় অংশ গঠন করে না সেগুলো দেখতে ব্যাকটেরিয়ার মতো।

ছত্রাকের সাথে অ্যাকটিনোমাইসিটিস এর সম্বন্ধপরাতা:
ছত্রাক যেমন মাইসেলিয়াম উৎপন্ন করে অ্যাকটিনোমাইসিটিসও তেমনি মাইসেলিয়াম তৈরি করে। পুষ্টি মাধ্যমে এদের বৃদ্ধি ছত্রাকের অনুরূপ। ছত্রাক ও অ্যাকটিনোমাইসিটিস উভয়ই জন্মায় মৃতজীবীরূপে। দুটো অণুজীবই কনিডিয়া উৎপন্ন করে। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দুটো জীবই সালোকসংশ্লেষণে অক্ষম।

অ্যাকটিনোমাইসিটিস কি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ? উত্তর হলো, হ্যাঁ। অ্যাকটিনোমাইসিটিস এর উপকারী ও অপকারী ভূমিকা রয়েছে।

উপকারী ভূমিকা:
  • জীবন রক্ষাকারী কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিক প্রস্তুত তরা হয় অ্যাকটিনোমাইসিটিস এর কিছু প্রজাতি থেকে। এই তালিকায় রয়েছে টেট্রামাইসিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, অরিওমাইসিন, নিওমাইসিন, ইরিথ্রোমাইসিন প্রভৃতি।
  • মাটিতে অবস্থানকারী অন্য অণুজীব নিয়ন্ত্রণ করে অণুজীবের সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে অ্যাকটিনোমাইসিটিস নির্গত অ্যান্টিবায়োটিক ভূমিকা পালন করে।
  • জৈব যৌগের পরিবর্তন ঘটিয়ে হিউমাস তৈরি করে অ্যাকটিনোমাইসিটিস। সবুজ সার, গোবর সার, কম্পোস্ট প্রভৃতি তৈরির সময় এরা উচ্চতাপমাত্রায় জৈবযৌগের পরিবর্তন ঘটায়।
  • পেকটিন, কাইটিন, ল্যাটেক্স এবং অ্যারোমেটিক যৌগসমূহ বায়বীয়ভাবে ভাঙ্গনরোধী। অ্যাকটিনোমাইসিটিস এসব যৌগের ভাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • মাটিতে অবস্থানরত জৈবযৌগকে খনিজকরণে ভূমিকা রাখে অ্যাকটিনোমাইসিটিস।

অ্যাকটিনোমাইসিটিসের অপকারী ভূমিকা:
  • এদের অনেক প্রজাতি মাটিস্থ বিভিন্ন উপাদান হিউমাস ও জৈবযৌগকে বিশ্লেষণ করে সরল উপাদানে পরিণত করে।
  • কিছু প্রজাতি মানুষের অ্যালার্জি সৃষ্টির জন্য দায়ী।
  • গরু-মহিষের লাম্ফি জ্ব বা চোয়াল ফোলা রোগের কারণ হলো অ্যাকটিনোমাইসিটিস।
  • গোল আলুর স্ক্যাব রোগ হয় অ্যাকটিনোমাইসিটিস এর আক্রমণে।
  • অ্যাকটিনোমাইসিটিস এর কারণেই মাছে কাদা কাদা গন্ধ হয়।

মন্তব্যসমূহ