মানবদেহের সংবহনতন্ত্র সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন: সংবহন প্রক্রিয়া কাকে বলে?

উত্তর: যে প্রক্রিয়ায় প্রাণিদেহে রক্ত পরিবহনের কাজ সম্পন্ন হয় তাকে সংবহন প্রক্রিয়া বলে।

প্রশ্ন: মানবদেহের সংবহনতন্ত্র কী কী নিয়ে গঠিত?

উত্তর: রক্ত, হৃৎপিণ্ড, ধমনি, শিরা এবং লসিকা ও লসিকাবাহী নালির সমন্বয়ে মানব দেহের সংবহনতন্ত্র গঠিত।

প্রশ্ন: রক্ত সংবহনতন্ত্র কাকে বলে?

উত্তর: যে তন্ত্রের মাধ্যমে দেহে রক্ত সঞ্চালিত হয় তাকে রক্ত সংবহনতন্ত্র বলে। হৃৎপিণ্ড, রক্ত ও রক্তবাহী নালির সমন্বয়ে রক্ত সংবহনতন্ত্র গঠিত।

প্রশ্ন: রক্ত কী? রক্তের স্বাদ কেমন?

উত্তর: রক্ত ঘন লাল রঙের একটি তরল পদার্থ। এটি এক ধরনের তরল যোজক কলা বা টিস্যু। রক্তের স্বাদ ক্ষারধর্মী।

প্রশ্ন: রক্তর উপাদান কতটি ও কী কী?

উত্তর: রক্তের উপাদান দুইটি, যথা-

১। রক্তরস

২। রক্তকণিকা

প্রশ্ন: রক্তরস কী? উত্তর: রক্তরস রক্তের তরল অংশ।

প্রশ্ন: রক্তের শতকরা কতভাগ রক্তরস?

উত্তর: সাধারণত রক্তের শতকরা ৫৫ ভাগ রক্তরস।

প্রশ্ন: রক্তরসে কী থাকে?

উত্তর: রক্তরসে আমিষ, লবণ ও অন্ত্র থেকে শোষিত খাদ্য উপাদান থাকে। রক্তরসে রক্তকণিকা ভাসমান অবস্থায় থাকে। এতে ফাইব্রিনোজেন নামে একটি উপাদান থাকে যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।

প্রশ্ন: রক্তরসে                        ভাসমান অবস্থায় থাকে। উত্তর: রক্তকণিকা। 

প্রশ্ন: রক্তরসের কোন উপাদান রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে?

উত্তর: রক্তরসে ফাইব্রিনোজেন নামে একটি উপাদান থাকে যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।

প্রশ্ন: রক্তরসের কাজ কী?

উত্তর:

-         রক্তরস দেহের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন, খাদ্যসার, হরমোন ইত্যাদি বহন করে।

-         দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে ক্ষতিকর পদার্থ যেমন- কার্বন ডাই-অক্সাইড, ইউরিয়া, ইউরিক এসিড ইত্যাদি বহন করে বিভিন্ন রেচন অঙ্গের মাধ্যমে দেহ থেকে বের করে দেয়।

প্রশ্ন: রক্তে কত ধরনের কণিকা রয়েছে?

উত্তর:  রক্তে তিন ধরনের কণিকা রয়েছে। যথা-

ক. লোহিত রক্তকণিকা। খ. শ্বেত রক্তকণিকা। গ. অণুচক্রিকা।

প্রশ্ন: কোন্ রক্তকণিকার জন্য রক্তের রঙ লাল দেখায়?

উত্তর: লোহিত রক্ত কণিকার জন্য রক্তের রঙ লাল দেখায়।

প্রশ্ন: লোহিত রক্ত কণিকার রঞ্জক পদার্থটির নাম কী? উত্তর: হিমোগ্লোবিন।

প্রশ্ন : কিসের সাথে অক্সিজেন যুক্ত হয়ে দেহকোষে পৌছায়?

উত্তর: হিমোগ্লোবিনের সাথে অক্সিজেন যুক্ত হয়ে দেহকোষে পৌঁছায়।

প্রশ্ন: লোহিত রক্ত কণিকার আকৃতি কেমন?

উত্তর: লোহিত রক্তকণিকা উভঅবতল যার উভয় পৃষ্ঠে খাদ আছে।

প্রশ্ন: লোহিত রক্তকণিকায়                    থাকে না। উত্তর: নিউক্লিয়াস

প্রশ্ন: লোহিত রক্তকণিকা কোথায় তৈরি হয়?

উত্তর: লোহিত রক্তকণিকা যকৃত ও অস্থিমজ্জায় তৈরি হয়।

প্রশ্ন: শ্বেত রক্তকণিকা কী?

উত্তর: শ্বেত রক্তকণিকা লোহিত রক্তকণিকার চেয়ে আকারে কিছুটা বড় ও অনিয়মিত আকারের হয়। এদের নিউক্লিয়াস আছে। প্লীহা ও অস্থিমজ্জায় এদের জন্ম। দেহে কোনো রোগ-জীবাণু প্রবেশ করলে শ্বেত রক্তকণিকা সেগুলোকে ধ্বংস করে। শ্বেত রক্তকণিকা দেহের প্রহরীর মতো কাজ করে। এদের সৈনিকের সাথে তুলনা করা হয়।

প্রশ্ন: অণুচক্রিকার পরিচয় দাও।

উত্তর: অণুচক্রিকা দেখতে গোলাকার বা বৃত্তের মতো। এরা লোহিত রক্তকণিকার চেয়ে আকারে ছোট হয় ও নিউক্লিয়াস থাকে না। এরা গুচ্ছাকারে থাকে। এদের উৎপত্তি লোহিত অস্থিমজ্জায়। দেহের কোনো অংশ কেটে রক্তপাত ঘটলে অণুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। এদের প্লেটলেটও বলে।

প্রশ্ন: রক্তের কাজ বর্ণনা কর।

উত্তর: রক্ত আমাদের দেহের একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। রক্ত দেহে নানা রকম কাজ করে। যথা-

১। খাদ্য পরিবহন: আমরা যে খাবার খাই, পরিপাকের পর সেগুলো সরল উপাদানে পরিণত হয় এবং রক্তের সাথে মিশে যায়। রক্ত সেই খাদ্যের সারাংশকে দেহের সর্বত্র বহন করে নিয়ে যায়। এভাবে দেহের কোষগুলোর পুষ্টি সাধন হয়।

২। অক্সিজেন পরিবহন: আমাদের দেহে সকল কাজের জন্য অক্সিজেন দরকার। অক্সিজেন না হলে জীবকোষ বাঁচতে পারে না। কাজেই খাবারের সাথে সাথে এদের দিতে হয় অক্সিজেন। রক্তের লোহিত রক্তকণিকায় অবস্থিত হিমোগ্লোবিন ফুসফুস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে। অক্সিহিমোগ্লোবিনরূপে প্রতিটি কোষে বহন করে।

৩। কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবহন: রক্তরস দেহের বিভিন্ন অঙ্গের কোষগুলোতে উৎপন্ন কার্বন ডাই-অক্সাইড বহন করে ফুসফুসে নিয়ে যায়।

৪। বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন: দেহে সৃষ্ট নাইট্রোজেন দ্বারা গঠিত দূষিত পদার্থ দেহ থেকে বের করে দেওয়ার কাজে সহায়তা করে।

৫। রোগ প্রতিরোধ: দেহে কোনো রোগজীবাণু প্রবেশ করলে রক্তের শ্বেত রক্তকণিকা সেগুলোকে মেরে ফেলে রোগ প্রতিরোধ করে।

৬। হরমোন পরিবহন: দেহের নালিহীন গ্রন্থিতে হরমোন উৎপন্ন হয়। রক্তের মাধ্যমে হরমোন দেহের বিভিন্ন অংশে পরিবাহিত হয়।

৭। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ: রক্ত দেহের বিভিন্ন অংশের তাপ পরিবহন করে। এতে দেহের সর্বত্র তাপমাত্রা ঠিক থাকে।

৮। রক্ত জমাট বাঁধা: দেহের কোনো অংশ কেটে গেলে রক্তপাত হয়। অণুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। ফলে রক্তপাত বন্ধ হয়।

প্রশ্ন: রক্তনালি কী?

উত্তর: যে নালির মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়, তাকে রক্তনালি বলে।

প্রশ্ন: আমাদের দেহে কত ধরনের রক্তনালি আছে?

উত্তর: আমাদের দেহে তিন ধরনের রক্তনালি আছে। যথা- ১. ধমনি ২. শিরা ও ৩. কৈশিকনালি।

প্রশ্ন: ধমনি কী? ধমনি কেমন রক্ত পরিবহন করে?

উত্তর: যে সকল রক্তবাহী নালি হৃৎপিণ্ড থেকে উৎপন্ন হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত বহন করে, তাকে ধমনী বলে। এরা দেহের ভিতর দিকে অবস্থিত। ধমনির প্রাচীর পুরু, গহ্বর ছোট এবং এর গহ্বরে কপাটিকা থাকে না। ধমনি অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পরিবহন করে।

প্রশ্ন: শিরা কী? শিরা কি ধরনের রক্ত পরিবহন করে?

উত্তর: যে সকল রক্তনালি দ্বারা দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে তাকে শিরা বলে। শিরা প্রাচীর অপেক্ষাকৃত পাতলা। এদের গহ্বরটি বড় ও গহ্বরের প্রাচীরগাত্রে কপাটিকা থাকে। দেহের কৈশিক জালিকা থেকে শিরার উৎপত্তি ঘটে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া শিরা সাধারণত কার্বন ডাইঅক্সাইডযুক্ত রক্ত বহন করে।

প্রশ্ন: কৈশিকনালি কী?

উত্তর: ধমনি ক্রমান্বয়ে শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত অতিসূক্ষ্ম নালি তৈরি করে। এই সকল সূক্ষ্মনালিকে কৈশিকনালি বা কৈশিক জালিকা বলে।

প্রশ্ন: শিরার উৎপত্তি কোথা থেকে হয়?

উত্তর: কৈশিকনালি থেকে শিরার উৎপত্তি।

প্রশ্ন: কৈশিকনালির প্রাচীর কী দিয়ে গঠিত?

উত্তর: এক স্তরবিশিষ্ট পাতলা এপিথেলিয়াল কোষ দিয়ে কৈশিকনালির প্রাচীর গঠিত।

প্রশ্ন: কৈশিকনালি কোথায় অবস্থান করে?

উত্তর: কৈশিকনালি দেহকোষের চারপাশে অবস্থান করে।

প্রশ্ন: হৃৎপিণ্ড কী?

উত্তর: হৃৎপিণ্ড বক্ষগহ্বরের বাম দিকে দুই ফুসফুসের মাঝখানে অবস্থিত একটি মোচাকৃতির অঙ্গ।

প্রশ্ন: হৃৎপিণ্ড কী দ্বারা আবৃত?

উত্তর: হৃৎপিণ্ড পেরিকার্ডিয়াম নামে দুই স্তরবিশিষ্ট একটি পাতলা পর্দা দ্বারা আবৃত।

প্রশ্ন: হৃৎপেশি কী?

উত্তর: হৃৎপিণ্ড হৃৎপেশি দ্বারা গঠিত। হৃৎপেশি এক ধরনের স্বাধীন অনৈচ্ছিক পেশি, যা কারো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া নিজে নিজেই সংকোচন ও প্রসারণে সক্ষম।

প্রশ্ন: হৃৎপিণ্ড প্রতি মিনিটে কতবার সংকোচিত ও প্রসারিত হয়?

উত্তর: হৃৎপিণ্ড প্রতি মিনিটে কমবেশি ৭২ বার সংকোচিত ও প্রসারিত হয়।

প্রশ্ন: হৃদস্পন্দন কী?

উত্তর: বুকের মাঝখানে হাত রাখলে ধুকধুকানি বা স্পন্দন টের পাওয়া যায়। হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণের ফলে এইরূপ ঘটে। এটা হৃদস্পন্দন।

প্রশ্ন: হৃৎপিণ্ড কতটি স্তরে গঠিত? স্তরগুলো কী কী?

উত্তর: হৃৎপিণ্ড তিন স্তরে গঠিত। যথা- ক. বাইরের স্তর বা এপিকার্ডিয়াম খ. মাঝের স্তর বা মায়োকার্ডিয়াম এবং গ. ভিতরের স্তর বা এণ্ডোকার্ডিয়াম।

প্রশ্ন: কোন স্তরের সংকোচনের কারণে হৃৎপিণ্ড পাম্প করে রক্ত সঞ্চালন করে?

উত্তর: মায়োকার্ডিয়াম হৃৎপিণ্ডের সবচেয়ে পুরু স্তর এবং এর সংকোচনের কারণে হৃৎপিণ্ড পাম্প করে রক্ত সঞ্চালন করে।

প্রশ্ন: হৃৎপিণ্ডে কতটি প্রকোষ্ঠ থাকে?

উত্তর: হৃৎপিণ্ড একটি চার প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট ফাঁপা অঙ্গ। হৃৎপিণ্ডের উপরের প্রকোষ্ঠ দুটির নাম ডান অলিন্দ ও বাম অলিন্দ এবং নিচের প্রকোষ্ঠ দুইটি যথাক্রমে ডান ও বাম নিলয়।

প্রশ্ন: হৃৎপিণ্ডের               প্রাচীর পাতলা ও                     প্রাচীর পুরু থাকে। 

উত্তর: অলিন্দের, নিলয়ের।

প্রশ্ন: আয়তনে অলিন্দগুলো নিলয়ের চেয়ে আকারে                     হয়।

উত্তর: ছোট।

প্রশ্ন: হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠগুলোর কোথায় কোথায় কপাটিকা রয়েছে?

উত্তর: ডান অলিন্দ ও ডান নিলয়ের মাঝে ডান অলিন্দ-নিলয় ছিদ্র থাকে। ঐ ছিদ্রপথে কপাটিকা থাকে। রক্ত এ ছিদ্রপথে অলিন্দ থেকে নিলয়ে প্রবেশ করতে পারে। অনুরূপভাবে বাম অলিন্দ ও নিলয়ের মাঝে কপাটিকা থাকে। এক্ষেত্রেও বাম অলিন্দ থেকে রক্ত কেবল মাত্র নিলয়ে প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া মহাধমনি ও বাম নিলয়ের সংযোগস্থলে ও ফুসফুসীয় ধমনি এবং ডান নিলয়ের সংযোগস্থলে অর্ধচন্দ্রাকৃতির কপাটিকা রয়েছে।

প্রশ্ন: কপাটিকা কী কাজ করে?  

উত্তর: কপাটিকাগুলো রক্তের গতিপথ একদিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

প্রশ্ন: হৃৎপিণ্ডের মাধ্যমে কীভাবে রক্ত সঞ্চালিত হয়?

উত্তর: হৃৎপিণ্ড হৃৎপেশি নামক এক বিশেষ ধরনের অনৈচ্ছিক পেশি দ্বারা গঠিত। যখন হৃৎপিণ্ডের সংকোচন হয় তখন হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত ধমনি পথে বিভিন্ন অংশে সঞ্চালিত হয়। আবার হৃৎপিণ্ডে যখন প্রসারণ ঘটে তখন দেহের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে রক্ত শিরা পথে হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। এভাবে হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণ দ্বারা রক্ত একবার হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করে আবার হৃৎপিণ্ড থেকে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে সঞ্চালিত হয়।


Comments