নির্দিষ্ট প্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রী জননকোষের নিউক্লিয়াসের পরস্পর একীভবনকে নিষেক বলে। যৌন প্রজননক্ষ প্রাণীদের জন্য নিষেক অপরিহার্য।
নিষেক ক্রিয়া:
নিষেক একটি জটিল প্রক্রিয়া। গোষ্ঠী ও প্রজাতিভেদে এর পার্থক্যও উল্লেখযোগ্য। নিচে একটি সাধারণীকৃত নিষেক প্রক্রিয়ার ধাপগুলোর বর্ণনা দেওয়া হলো:
১) ডিম্বাণু গাত্রে শুক্রাণুর সংযোগ:
শুক্রাণু ও ডিম্বাণু গ্যামোন নামে হরমোন সদৃশ্য কিছু পদার্থ বহন করে।
শুক্রাণুর গ্যামোনকে অ্যান্ড্রোগ্যামোন এবং ডিম্বাণুর গ্যামোনকে গাইনোগ্যামোন বলে।
শুক্রাণুর অ্যান্ড্রোগ্যামোন দুরকম: একটি শুক্রাণুর অতিরিক্ত কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে শক্তি সংরক্ষণ করে, অন্যটি ডিম্বাণুর চারপাশের জিলেটিনময় আবরণী বিগলিত করে শুক্রাণুর প্রবেশকে সহজতর করে।
গাইনোগ্যামোনও দুধরনের- একটি প্রথম অ্যান্ড্রোগ্যামোনের প্রতি সাড়া দিয়ে শুক্রাণুর কার্যকলাপের বৃদ্ধি ঘটায়, অপরটি শুক্রাণুর মস্তককে আঠালো করে ডিম্বাণুর গায়ে সংযোগ ঘটায়।
ডিম্বাণুর অভ্যন্তরে প্রবেশের আগে শুক্রাণু এক বিশেষ পদ্ধতিতে ডিম্বাণুর গায়ে সংলগ্ন হয়। এ প্রক্রিয়াকে ফার্টিলাইজিন-অ্যান্টিফার্টিলাইজিন পদ্ধতি বলে।
ডিম্বাণুর চারপাশের জেলীময় আবরণীতে ফার্টিলাইজিন এবং শুক্রাণুর সাইটোপ্লাজমে বহির্দেশে অ্যান্টিফার্টিলাইজিন নামক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে।
অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডির লক অ্যান্ড কী প্রক্রিয়ায় ফার্টিলাইজিন অ্যান্টিফার্টিলাইজিনের সাময়িক বন্ধন সৃষ্টি হওয়ায় ডিম্বাণুর দেহ তলে শুক্রাণু সংলগ্ন হয়।
উল্লিখিত দুটি পদার্থই প্রজাতি-নির্দিষ্ট, তাই এক প্রজাতির শুক্রাণু কখনোই অন্য প্রজাতির ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারে না।
ডিম্বাণু থেকে উৎপন্ন ফার্টিলাইজিনে সাড়া দিয়ে অসংখ্য শুক্রাণু গুচ্ছবদ্ধ হয়ে পড়ে।
২) ডিম্বাণুর অভ্যন্তরে শুক্রাণুর প্রবেশ:
শুক্রাণুর অ্যাক্রোসোম থেকে স্পার্ম লাইসিন নামক এনজাইম প্রকৃতির এক ধরনের পদার্থ ক্ষরিত হয়।
ডিম্বাণু ঝিল্লির যে স্থানে শুক্রাণু সংলগ্ন থাকে সে স্থানকে স্পার্ম লাইসিন বিগলিত করে শুক্রাণুর প্রবেশ পথের সৃষ্টি করে।
স্তন্যপায়ীর ক্ষেত্রে ডিম্বাণুর জোনা রেডিয়াটা আবরণী ভেদ করার জন্য যে এনজাইম ব্যবহৃত হয় তার নাম হায়ালুরোনিডেজ।
৩) পেরিভিটেলাইন স্পেস ও নিষেক ঝিল্লির সৃষ্টি:
একটি শুক্রাণু ডিম্বাণুকে বিদীর্ণ করার সঙ্গে সঙ্গে ডিম্বাণুর ভিটেলাইন ঝিল্লি প্লাজমা মেমব্রেন থেকে সামান্য উপরে উঠে যায়, ফলে দুই ঝিল্লির মাঝখানে যে ফাঁকা স্থানের সৃষ্টি হয়, তাকে পেরিভিটেলাইন স্পেস বলে।
তখন এই স্পেস জুড়ে ভিটেলাইন ও পেরিভিটেলাইন ঝিল্লি একত্রে মিলে নিষেক ঝিল্লি নামে আরেকটি ঝিল্লি সৃষ্টি করে (স্তন্যপায়ীতে হয়না)।
এ ঝিল্লি সৃষ্টি হওয়ায় বিলম্বে আসা শুক্রাণু ডিম্বাণুর অভ্যন্তরে প্রবেশে বাধা পায়।
৪) ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজমে পরিবর্তন:
ডিম্বাণুর যে স্থানে শুক্রাণু প্রবেশ করে সে স্থানের সাইটোপ্লাজমে প্রবেশ কোণ নামে একটি কোণাকৃতির বহিঃবৃদ্ধি ঘটে।
প্রবেশ কোণটি শুক্রাণুর মস্তক ও মধ্যখন্ডসহ ডিম্বাণুর গভীরে প্রবেশ করে। শুক্রাণুর মস্তক ডিম্বাণু-তল বিদীর্ণ করার পরপরই লেজের আন্দোলন থেমে যায়।
শুক্রাণুর মস্তক ও মধ্যখন্ড ডিম্বাণুর ভেতরে প্রবেশ পথ বা বিদীর্ণ পথ ধরে অগ্রসর হয়। তখন অ্যাক্রোসোম অদৃশ্য হয়ে যায় এবং মস্তকে ক্রোমাটিনগুলো জালিকা গঠন করে।
অন্যদিকে মধ্যমাংশে একটি সেন্ট্রিওল ও সেন্ট্রোসোমের আবির্ভাবের ফলে একটি নতুন বিভাজন কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। তখন নিউক্লিয়াসটিকে পুরুষ প্রোনিউক্লিয়াস বলে।
৫) ডিম্বাণু ও শুক্রাণু নিউক্লিয়াসের একীভবন:
উপরে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আগে বা চলাকালীন সময় ডিম্বাণুর দ্বিতীয় মায়োটিক বিভাজন সম্পন্ন হয়ে যায় এবং নিউক্লিয়াসটি প্রান্তদেশ থেকে ডিম্বাণুর প্রায় কেন্দ্রে চলে আসে।
দ্বিতীয় মায়োটিক বিভাজনের পর ডিম্বাণুর হ্যাপ্লয়েড নিউক্লিয়াসকে স্ত্রী প্রোনিউক্লিয়াস বলে।
প্রবেশ পথ ধরে এগিয়ে আসা নতুন শুক্রাণু-বিভাজনকেন্দ্র ও নিউক্লিয়াস সরাসরি ডিম্বাণু -নিউক্লিয়াসের দিকে ধাবিত হয়। তখন এ গতিপথের অংশকে মিলন পথ বলে।
নিউক্লিয়াস দুটি পরস্পরের কাছাকাছি হলে এদের আবরণী অদৃশ্য হয়ে যায়, এদের অংশগুলো মিলিত হয়ে একটি পিন্ড গঠন করে এবং একটি অভিন্ন নিউক্লিয়ার মেমব্রেনে বেষ্টিত হয়ে জাইগোট গঠন করে।
এভাবে, পুরুষ ও স্ত্রী প্রোনিউক্লিয়াসের জাইগোট গঠনের মধ্যে দিয়ে নিষেক সম্পন্ন হয়।
নিষেকের গুরুত্ব বা তাৎপর্য:
নিষেক পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্যকে সমন্বিত করে।
নিষেকের ফলে জাইগোটে জীনের নতুন সমন্বয় ঘটে এবং এতে জীবে প্রকরণের সূচনা হয়।
নিষেকের ফলে ডিম্বাণু পরবর্তী পর্যায়ের বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত হয়।
নিষেক জীবের ডিপ্লয়েড সংখ্যাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে।
নিষেক ডিম্বাণুর বিপাক হার ও প্রোটিন সংশ্লেষণ হার বৃদ্ধি করে।
নিষেকের মাধ্যমে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারিত হয়।
নিষেক জীবের বংশ রক্ষার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।
Comments
Post a Comment